খলিফা হারুন অর রশিদের পরিচয়
জন্ম ও পরিচয়: হারুন অর রশীদ ছিলেন খলিফা আল মাহদীর পুত্র এবং খলিফা আল হাদীর ভ্রাতা। তার মায়ের নাম ছিল খায়জুরান। হারুন অর রশীদ ছিলেন আব্বাসীয় রাজবংশের ৫ম শাসক। তার প্রকৃত নাম ছিল হারুন অর রশীদ ছিল তার ধারণকৃত উপাধি।
খলিফা হারুন অর রশীদের পরিচয় দাও |
. খিলাফত লাভ: হারুন অর রশিদের ভ্রাতা আল হাদীর মৃত্যুর পর ৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে ২৫ বছর বয়সে বাগদাদের সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং তিনি ৮০৯ খ্রি. পর্যন্ত আব্বাসীয় খিলাফতে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
খলিফা হারুন অর রশীদ একজন ধর্মপ্রাণ খলিফা ছিলেন। তিনি দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। তিনি উত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। ন্যায়বিচার ও দানশীলতার জন্য হারুন জগদ্বিখ্যাত ছিলেন।
তিনি প্রজাসাধারণের মাঝে অকাতরে ধনসম্পদ দান করতেন। তার চরিত্রের আরেকটি গুণ ছিল ভালো- মন্দের অপূর্ব সম্মিলন। তিনি বিরোধীদের প্রতি যেমন কঠোর ছিলেন তেমনি প্রজাসাধারণ ও বন্ধুদের সাথে ছিলেন অত্যন্ত সহৃদয়।
তবে তিনি অতিমাত্রায় অন্যের কথায় বিশ্বাসী ছিলেন বলে তার অকৃত্রিম বন্ধু বার্মাকি পরিবারের ধ্বংস সাধন করেছিলেন যা ছিল তার চরিত্রের এক দুর্বল বৈশিষ্ট্য।
শ্রেষ্ঠ শাসক: হারুন অর রশীদ আব্বাসীয় খলিফাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং তৎকালীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নরপতিগণের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তিনি ন্যায়বিচারক, প্রজারঞ্জক শাসনকর্তা হিসেবে বিশ্বে সমধিক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
অরাজকতা দমন করতে এবং প্রজাসাধারণের অবস্থা স্বয়ং অবগত হবার জন্য তিনি ছদ্মবেশে নগর ভ্রমণ করতেন। নিয়ম অনুযায়ী আব্বাসীয় শাসনব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার দায়িত্ব পারস্যের শিয়া মতাবলম্বী বার্মাকি পরিবারের উপর ন্যস্ত ছিল।
তার সুদীর্ঘ তেইশ বছরের শাসনামলে রামাকি বংশ সতেরো বছর শাসনকার্য পরিচালনা করে সাম্রাজ্যের সুখ ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠা করে।
জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা: খলিফা হারুন জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তার সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়। তাঁর আমলে বিশ্ববরেণ্য পণ্ডিত মনীষীগণের মিলনভূমি ছিল বাগদাদ। হিট্টি বলেন, "এই যুগ পৃথিবীর ইতিহাসকে যে কারণে গৌরবোজ্জ্বল করেছে তা হচ্ছে, এ আমলই ইসলামের ইতিহাসের জ্ঞান-বিজ্ঞানের সর্বাপেক্ষা উৎকর্ষের যুগ। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় মনসুরের প্রতিষ্ঠিত অনুবাদ বিভাগ সম্প্রসারিত হয়। হারুনের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রধান বিচারপতি ইমাম আবু ইউসুফের নেতৃত্বে হানাফী মাযহাব আত্রকাশ করে। ইমাম বুখারী হাদীস শাস্ত্র প্রণয়ন করেন। আবু নুয়াস ও আতাইয়া সাহিত্যে এবং আসমায়ী ব্যাকরণে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন।" খলিফার নির্দেশে আর পণ্ডিতগণ গ্রীকসহ প্রভৃতি ভাষার বিজ্ঞান ও দর্শনের গ্রন্থরাজী আরবী ভাষায় অনুবাদ করেন। তিনি 'মানকা' নামক ভারতীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও জ্যোতির্বিদকে বাগদাদে আমন্ত্রণ করেন। সঙ্গীতজ্ঞ ও নৃত্য শিল্পীগণও হারুনের দরবারকে অলংকৃত করত। এ সময়ে রচিত হয় বিখ্যাত আরব্য উপন্যাস। ঐতিহাসিক গীবন। বলেন- আরব্যোপন্যাস ব্যতীত- 'রবিনসন ক্রুসো' এবং সম্ভবত গ্যালিভারের ভ্রমণ কাহিনী রচিত হত না।'
হারুন অর রশীদ শুধু
একজন ধর্মীয় শাসকই
ছিলেন না বরং সমগ্র
মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে
একজন শ্রেষ্ঠ শাসক
হিসেবে নিজের অবস্থান
সুসংহত করেছেন। তার নৈশভ্রমণ ও মানবকল্যাণের স্তুতি নিয়ে বহু আরব্য উপন্যাস রচিত হয়েছে। যাতে তার প্রশংসা কীর্তি, ধার্মিকতা ও মানবকল্যাণের চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। বাদশা হারুণ অর রশীদ নৈশ ছদ্মবেশে প্রজাদের অবস্থা স্বচোখে দেখতে বের হতেন।
গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমে বিভোর তখন নির্জন রাজপথে মলিন পোশাকে দুজন মুসাফিরকে দেখা যেত। একজন বৃদ্ধ অন্যজন তরুণ। তাদের অনিদ্রার রোগী বলেও মনে হতে পারত। বস্তুত বৃদ্ধ স্বয়ং বাগদাদের খলিফা হারুন অর রশীদ আর তরুণটি খলিফাপুত্র আল মুহতাসীম। খলিফার প্রশাসনিক দক্ষতার কারণেই আব্বাসীয় খিলাফতের শাসন দৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
আর এ ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই তার পরবর্তীতে আব্বাসীয় খিলাফত দীর্ঘদিন শাসন ক্ষমতায় টিকে ছিল। হারুন অর রশীদের অন্যতম উত্তরাধিকারী আল মামুনের হাত ধরে তা আরও সুসংগঠিত হয়। এসব কৃতিত্বের দাবিদার হিসেবে হারুন অর রশীদকে স্বীকৃতি দেওয়াই যেতে পারে।
কেননা বলা হয়ে থাকে তার কারণেই আব্বাসীয় খিলাফত দীর্ঘ প্রায় পাঁচশ বছর শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন। হারুন অর রশীদের আরও একটি স্বভাবজাত নিয়ম ছিল। রাতের খাবার কোনো একজন মুসাফিরকে সঙ্গে নিয়ে খাওয়া। শুনতেন তার মনে কথা। বাদশা চেষ্টা করতেন সেই মুসাফিরের কোনো ইচ্ছা পূরণ করতে।
0 Comments